Powered By Blogger

Friday, May 2, 2025

প্রবন্ধঃ এ সব ভাবা কি ইউটোপিয়া?

রাস্তার কুকুর নিয়ে সব জায়গায় একটা সমস্যা রয়েছে। কুকুর প্রেমী ও কুকুরদের প্রতি কারণে ও অকারণে অত্যাচার করা মানুষের মধ্যে আছে বিরোধ। কুকুরদের সম্পর্কে মানবতা, নৈতিকতা ও ভয়, আতঙ্ক নিয়ে আছে তর্কবিতর্ক। পরিশেষে হয় মানুষে মানুষে বিরোধ ও বিভেদ।
কুকুরদের নিয়ে ভালোমন্দ এর দু'টো দিকই আছে। রাতের বেলা এরা ভয়ঙ্কর হ'য়ে ওঠে। বিশেষ ক'রে এরা যখন দল বেঁধে রাস্তায় ও গলির মধ্যে থাকে। একজন ঘেঊ করলে সকলেই তেড়ে আসে। স্বাভাবিকভাবে বেশীরভাগ মানুষ কুকুর ভর্তি ঐসব রাস্তায় চলাফেরা করতে, বিশেষ ক'রে রাতের বেলা ভয় পায়। তারপর যদি রাস্তার কোনও কুকুর যে কোনও কারণে পাগল হ'য়ে যায় তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হ'য়ে ওঠে। এর ওপর আছে এদের বংশ বিস্তার। এই বিশেষ সময়ে এরা ভয়ঙ্কর হ'য়ে ওঠে। দিনেরাতে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা বিপদের এবং লজ্জারও কারণ হ'য়ে ওঠে। যদিও এই বিশেষ সময়ের পরিধি এখন আর সীমাবদ্ধ নেই, পরিধির বিস্তার হয়েছে।

আর, আছে রাস্তায় বেপরোয়া সাইকেল, বাইক চালক বা গাড়ী চালক। এদের উচ্ছৃঙ্খল গাড়ী চালানোর জন্য যদি এদের কারও গায়ে আঘাত লাগে বা বাচ্চা কুকুরের কিছু হ'য়ে যায় তখন সেই রাস্তা বেশ কিছুদিন মানুষজনের যাতায়াতের জন্য ভয়ঙ্কর হ'য়ে ওঠে। বিশেষ ক'রে দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে যাওয়া সাইকেল, বাইক বা গাড়ী চালকের কাছে।

এরপর আছে যখন তখন, মাঝরাতে কিংবা অতি ভোরে এদের হঠাৎ দলবদ্ধভাবে কান ফাটানো চীৎকার, যা বয়স্ক লোকের কাছে হঠাৎ স্ট্রোকের কারণ হ'য়ে মৃত্যুকে পর্যন্ত ডেকে আনে। বিশেষ ক'রে যদি রাস্তার ধারে বা গলির মধ্যে ফ্ল্যাট বা বাড়ি হয়।

এছাড়া আছে রাস্তায় এদের যত্রতত্র মল ত্যাগ। বিশেষ ক'রে বর্ষার সময় যত্রতত্র এদের মলত্যাগ বিভীষিকা হ'য়ে দাঁড়ায়, যা চন্দনের মতো রাস্তা জুড়ে লেপটে যায় মানুষ ও গাড়ী চলাচলের কারণে। মানুষের পায়ে পায়ে তা' মিলিয়ে যায় রাস্তায়, কখনো বা রাস্তায় লুটোতে থাকা পড়নের কাপড়ে। আর, নারীপুরুষ তা পাড়িয়ে জুতো বা পায়ে ক'রে বা কাপড়ে লাগিয়ে ঘরে আসে।

এ সমস্ত কিছু এরা করে অবলা প্রাণী হওয়ার কারণে। এরাও ট্রেনিং পেলে উন্নত সভ্য মানুষের চেয়েও উন্নত ও সভ্য হ'য়ে ওঠে। কিন্তু রাস্তার কুকুরের জন্য কার আছে সেই মাথাব্যথা? মানুষ যেখানে মানুষের কাছে সামান্য সহানুভূতি পায় না সেখানে পশুদের নিয়ে কার মাথা ব্যথা আছে, পশু প্রেমী ছাড়া? আবার পশু প্রেমীরাও রাস্তায় খাবার দিয়ে এদের প্রেম সারে। কেউ কেউ বা মানবিকতার উন্নত প্রকাশও ঘটায় এদের নানারকম চিকিৎসা ক'রে। এরা বিভিন্ন ভাবে পশুদের প্রতি তাদের প্রেম ব্যক্ত করে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এর চেয়ে বেশী কি করতে পারে? করতে পারে না। এটা একক কাজ নয়।
আবার এই কুকুরদের প্রতি প্রেম প্রসঙ্গে আসে মায়ের সামনে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পুজোর নামে বলি প্রথা বা জীব হত্যার কৃষ্টি-সংস্কৃতি। আর এ আছে প্রায় সব ধর্মের মানুষের মধ্যে। এই যে মা কালীর সামনে যুগ যুগ ধ'রে অবলা ছোট্ট ছোট্ট শিশু ছাগলগুলিকে বলি দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ আছে কুকুর প্রেমীদের? হয়তো ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু যারা কুকুর প্রেমী তাদেরও তখন দেখি পাঁঠা বলির বিরুদ্ধে রক্তমাংসহীন অমূর্ত মাটির তৈরী মায়ের নামে প্রতিবাদে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে, কারণ মা রাগ করবে, মা অভিশাপ দেবে। কিন্তু সেই মা কখনও আজ পর্যন্ত মায়ের পূজার নামে হত্যা যজ্ঞের সময় সেই ব'য়ে যাওয়া ছোট্ট ছোট্ট ছাগ শিশুদের আর্তনাদ, ছিন্ন ভিন্ন রুক্তাক্ত মাথা ও শরীর এবং রক্তের ব'য়ে যাওয়া স্রোতের সামনে এসে ঐরকম ভয়াল চোখে খাঁড়া হাতে এসে দাঁড়ান নি, দাঁড়ান না। আর, সেই কচি পাঁঠার মাংস ভক্তি ভরে কপালে ঠেকিয়ে মায়ের প্রসাদ হিসেবে কুকুর প্রেমীরা রসিয়ে তৃপ্তি ভরে খায়।

ডাকাত, ঠগীদের আরাধ্যা দেবী মা কালী যার সামনে পুজো দিয়ে ডাকাত ও ঠগীরা লুটপাট ও মানুষ হত্যা করতে বের হ'তো সেই ডাকাত, ঠগীদের কালী পূজাও সাধারণ মানুষের কাছে জাগ্রত, জীবন্ত কালী হিসেবেও কালে কালে জনপ্রিয় হয়েছে, মায়ের প্রতি ভক্তি বিশ্বাস হয়েছে তীব্রতর। এমনকি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এমনই প্রবল যে প্রচলিত আছে ডাকাত কালীকে সিদ্ধেশ্বরী কালী হিসেবেও পূজা করা হয়, এবং অনেকে মনে করেন যে দেবী এতটাই শক্তিশালী যে তাঁকে শিকলে বেঁধে রাখা হয়। কি সীমাহীন ভয়ংকর অজ্ঞানতা, অজ্ঞতা এবং মিথ্যা ও পাপাচার ও তার প্রচার যে স্বয়ং জগন্মাতাকে জগন্মাতার সৃষ্ট জীব মানুষ তার ঠুনকো শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারে এমন আহাম্মকি ঔদ্ধত্বপূর্ণ আস্পর্ধা দেখায়!

তাহ'লে অন্যায় অধর্ম করতে, মানুষের ধনসম্পদ লুটপাট করতে, মানুষকে হত্যা করতে, মায়ের সামনে মায়ের পূজার নামে মায়ের সন্তানকে বলির নামে হত্যা করতে, এমনকি কোথাও কোথাও সিদ্ধি লাভের জন্য নরবলি দিতেও যে ডাকাত, ঠগী বা তান্ত্রিক নাম্নী মানুষদের হাত কাঁপে না, বুক কাঁপে না, মানবতার ধার ধারে না, মনুষ্যত্ব যাদের লুপ্ত হ'য়ে গেছে তাঁদের পূজা পদ্ধতির পৃষ্টপোষক কে? মা, নাকি আমরা সাধারণ মানুষেরা? আমরা কেন ডাকাত, ঠগীরা মানুষকে হত্যা করা ও মানুষের ধন সম্পদ লুঠ করার জন্য যে আরাধ্য দেবতার আরাধনা করে ও আরাধনা শেষে লুঠ করে, হত্যা করে আমরা কেন সেই দেবতার পুজো করবো? প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই জাগে সচেতন মানুষের মনে।

আরও প্রশ্ন জাগে, মা তো বোবা, মা তো কথা বলতে পারে না, বলতে পারে না, 'তোরা অন্যায় করছিস, অপরাধ করছিস, ঘোর পাপ করছিস আমার কাছে পুজো দিয়ে তোরা আমারই সন্তানের ধন সম্পদ লুট করতে বের হচ্ছিস, লুটপাট করার সময় মানুষ আমার সন্তানদের হত্যা করছিস, আমার সামনে আমার পূজার নামে আমার সৃষ্টি অসহায় নিরীহ ছোট্ট ছোট্ট জীবগুলিকে নারকীয় মানসিকতায় হত্যা ক'রে আমাকেই আমার সন্তানের রক্ত দিয়ে স্নান করাচ্ছিস, আমাকেই আমার সন্তানের মাংস রান্না ক'রে ভোগের নামে, প্রসাদের নামে আমাকে খাওয়াবার নাম ক'রে নিজেরা খাচ্ছিস, সাধারণ মানুষের সামনে ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরী ক'রে আমাকে আমার সন্তানদের কাছে ভয় বিভীষিকার মূর্ত প্রতীক ক'রে তুলছিস ও তাদের আমার নামে, ভক্তির নামে, পূজার নামে, সিদ্ধিলাভের নামে, মনস্কামনা পূরণের নামে বোকা বানাচ্ছিস, জীব বলি দেওয়ার জন্য মানত করাচ্ছিস?' মা বলতে পারে না, 'তুই তোর অজ্ঞানতা, অজ্ঞতার কারণে, নিজের কপট ভক্তির কারণে আমাকে মিথ্যে মিথ্যে 'কারও কাছে ভক্তি, কারও কাছে ঘৃণার পাত্র ক'রে তুলছিস?' মা তো এতো রক্তপাতের পরেও, এত হাজার হাজার নির্ম্মম নৃশংস নারকীয় বীভৎস ভয়াবহ হত্যার পরেও কখনও ভয়ঙ্কর ভয়াল রূপ ধারণ ক'রে বলতে পারে না, 'তুই আমার সন্তান? তুই এতো বড় পাপী, পাষন্ড, নরাধম?' বলতে পারে? বলেছে কখনও? ভয়াল কঠোর প্রতিবাদ করেছে কখনও? বলেনি, করেনি।

উল্টে আমরা কি শুনেছি? শুনেছি, মা নাকি ঐ নরাধম পাপী পাষন্ড ভক্তদের স্বপ্ন দেখিয়েছে, স্বয়ং দেখা দিয়েছে আর বলেছে, 'আমাকে রক্ত দে, আমার বড় তৃষ্ণা পেয়েছে, আমাকে পাঁঠা, মোষ বলি দে।' আর, আমরা সীমাহীন ভাঙাচোরা, মূর্খ, বেকুব, ভীরু, দুর্বল, অজ্ঞ, অন্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন মানুষ তা বিশ্বাস করেছি, আর তাদের বলিষ্ট পৃষ্টপোষক হয়েছি।

তাই সুযোগসন্ধানী কপট ভক্তিপূর্ণ মানুষও এই ভয়মিশ্রিত দৃশ্যমান বোবা ভগবানকে দুর্বল, ভীরু, মূর্খ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের পৃষ্টপোষতায় জাগ্রত ভগবানে পরিণত করেছে। যার ফল, ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নামে শুধু হত্যা, হত্যা আর হত্যা। কিছু না ক'রে ফোকটে অলৌকিকভাবে কিছু পাওয়ার মানসিকতায় মগ্ন ক'রে সীমাহীন ভাঙাচোরা মানুষকে মত্ত ক'রে তুলেছে। তাই আজ এই অমুর্ত ভগবানের রমরমা বাজার।

যাই হ'ক, পরিশেষে শুধু এটাই বলতে পারি, রাস্তার কুকুরের প্রতি প্রেম বা অমানবিক আচরণ যেটাই হ'ক না কেন, আর, মায়ের পুজোর নামে জীব হত্যা এবং মানুষকে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে বের ক'রে আনা, মানুষকে মানবিক ও বিবেকবান ক'রে তোলা, মানুষের মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখা ইত্যাদি এ সমস্ত কিছুর মাঙ্গলিক সমাধান একমাত্র রাষ্ট্রের হাতে। রাষ্ট্র চাইলেই সব হ'তে পারে, স্বর্গ তৈরী করতে পারে দেশকে রাষ্ট্র।
আছে কি দেশে এমন আদর্শবান ইষ্টপ্রাণ কর্ণধার? এ সব ভাবা কি ইউটোপিয়া?

No comments:

Post a Comment