'কেউ অপরিহার্য নয়'----- (১- জ্যোতি বসু )

'কেউ অপরিহার্য নয়' এই বিকৃত, অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক দর্শন গ্রহণ করার ফল কি হয়েছিল তা পরবর্তী কাহানীগুলিতে একে একে তুলে ধরা হ'ল।

  

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের শাসনব্যবস্থায় জ্যোতিবাবুর অনুপস্থিতি। মমতার আক্রমণে রাজ্যের নির্বাচনী ময়দান থেকে সরে দাঁড়ালেও দেশের সংকট মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলির কাছে সর্ব্বসম্মতিতে তাঁর প্রশ্নাতীত গ্রহণযোগ্যতা দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের অযৌক্তিক, ভুল ও ষষ্ঠরিপুর তাড়নায় ইর্ষান্বিত সিদ্ধান্তের কারণে বাস্তবায়িত হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি হয়। মতভেদ চরম আকার ধারণ করলে সেই অবাস্তব অবৈজ্ঞানিক যুক্তি ‘কেউ অপরিহার্য নয়’ সুকৌশলে সামনে চলে আসে। জ্যোতিবাবুর আর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হ'ল না, দেশ একজন অসাধারণ প্রশাসক পেল না, বাঙালী নেতাজীর পর দ্বিতীয় বাঙালী প্রধানমন্ত্রী পাওয়া থেকে বঞ্চিত হ'ল ইত্যাদি যাই হ'ক না কেন সেই এক বাক্য 'কেউ অপরিহার্য নয়' গিলে ফেলল গোটা দলকে, গোটা দেশকে। দলীয় সিদ্ধান্তকে জ্যোতি বসু 'ঐতিহাসিক ভুল' আখ্যা দিয়ে দলের বিরাগভাজন হয়ে পড়লেন। দেশ একজন যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অসাধারণ কম্যুনিস্ট প্রশাসক থেকে বঞ্চিত হল। দেশবাসী তথা বিশ্ব দেখতে পেল না ভারতের মতন বিশাল একটা দেশে একজন কম্যুনিস্ট কি করে দেশকে নেতৃত্ব দেয়! প্রমাণ হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল না মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে একনায়কতন্ত্রের দীর্ঘ সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি এই জটিল বহু মতবাদ, বহু দলীয় ব্যবস্থায় ঘেরা ভারতের বুকে তাঁর পরীক্ষিত একনায়কতন্ত্রের ঘোড়াকে কিভাবে ছুটিয়ে নিয়ে যান। সুযোগ পাওয়া গেল না দেখার রাজ্যের গন্ডী ছাড়িয়ে বহু ধর্ম, বহু মত, বহু দল, বহু জাতি, বহু সম্প্রদায়, বহু ভাষা ইত্যাদি দিয়ে ঘেরা এই বিশাল জটিল ভারতবর্ষকে শাসন করার পক্ষে একজন কম্যুনিস্ট হিসাবে তিনি কতটা যোগ্য, কতটা দক্ষ, কতটা প্রাজ্ঞ এবং বিভিন্ন নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কতটা ভারসাম্য রক্ষা করার বুদ্ধি ও শক্তির অধিকারী! প্রমাণ পাওয়া গেল না শুধুমাত্র সেই 'সমষ্টি নামক দর্শনে বিশ্বাসী মুখোশ পরা কতিপয় মানুষের ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে।

তাঁর পরবর্তী সময়ে যখন বামপন্থীদের পায়ের তলার মাটি সরতে সরতে বিশাল খাদ-এর আকার গ্রহণ করে তখন দ্বিধাহীন চিত্তে দলের বোদ্ধা প্রবীণ সহকর্ম্মীরা তাঁর স্মরণ সভায় দলের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার কথা স্মরণ করে তাঁর স্মৃতিতে প্রকাশ্যে চোখের জল ফেলতে ফেলতে স্বীকার করেন জ্যোতি বসু দলে কতটা অপরিহার্য ছিলেন। প্রমাণ হয় ব্যক্তির ভূমিকা কত বড়! কায়েমী স্বার্থের এক অদ্ভুত নির্লজ্জ প্রতিফলন!
 

প্রমাণ হ'ল কেউ পরিহার্য নয়। সবাই সবার জায়গায় অপরিহার্য!
ক্রমশঃ