১) দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের "এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি" গানে কোন দেশের কথা বলা হয়েছে? বাংলাদেশের? নাকি ভারতের? যদি ভারতের হ'য়ে থাকে তাহ'লে বিবেচিত হয় কি ক'রে? কোন যুক্তিতে? আর, বিবেচিত হয়েছে বলেই মেনে নিতে হবে এটা মান্যতা পাবে বা এখানে হিন্দু-মুসলমানের গন্ধ নাই?
২) দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানে ভায়ের মায়ের মিষ্টি মধুর স্নেহের কথা বলা হয়েছে তা' আমরা কি সেই মিষ্টি মধুর স্নেহের গন্ধ আর পাই দুই দেশের ভায়ের আর মায়েদের মধ্যে?
৩) আমরা গত কয়েকদিন ধ'রে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙ্গার মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেসবুকের নানা বিকৃত পোষ্টে, কমেন্ট বক্সে যে অপমান, অশ্রদ্ধা, অপবাদ, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, গালাগালি, কুৎসা, চরিত্রহনন, সাম্প্রদায়িক মন্তব্য ইত্যাদি করার মধ্যে দিয়ে যে ঘৃণা ঝ'রে পড়তে দেখলাম বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে অবস্থানকারী, সাম্প্রতিক পট পরিবর্তনের সমর্থক তামাম ছাত্রছাত্রী, আম নাগরিকের মধ্যে তা' থেকে কি প্রমাণ হয় না রবীন্দ্রনাথ হিন্দু বলেই তার বিরুদ্ধে এত জনরোষ?
৪) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা' গানটি অখন্ড বাংলাকে নিয়ে লেখা হয়েছে ব'লে সেই গানটি একটি সম্পূর্ণ বাংলাভাষী দেশের জাতীয় সঙ্গীত হ'তে পারবে না? এ তো অদ্ভুত যুক্তি? জোর ক'রে বলপ্রয়োগে হাঁ-কে না করানো আর না-কে হাঁ করানোর মত সমতুল্য ব্যাপার হ'য়ে দাঁড়ালো?
৫) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ আর বাঙালী জাতীয়তাবাদ নিয়েও কথা উঠে গেল? এ তো অদ্ভুত এক ভাঙনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের শরীরে-মনে-আত্মায় যে নোংরা দূষিত মনের বিষ ছড়িয়ে গেছিল ব্রিটিশ ডিভাইড এন্ড রুল ভাঙ্গন তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষকে। আর, তার ট্রাডিশান ব'য়ে চলেছে দেশভাগের ৭৮ বছর পরেও দেশ ভাগ ক'রে। ব্রিটিশ ও তৎকালীন দেশনেতৃবৃন্দ বুঝিয়েছিল দেশ ভাগ করার মধ্যে দিয়ে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু তা যে হবে না বরং উল্টো হবে, দেশ ভাগ করার মধ্যে দিয়ে তা দিয়ে দিয়ে শত্রুতার যে ডিম ফোটানোই হবে তা আজ সত্য হ'লো। আজ বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি আবারো আরও একবার এই সত্য প্রমাণ করলো।
৬) একটা মিষ্টি সুন্দর গান যে গানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইনের মধ্যে বাংলাদেশের মাটি, জল, বায়ু, ফল, ঘর, হাট, বন, মাঠ এবং বাঙ্গালীর পণ, আশা, কাজ, ভাষা, প্রাণ, মন, ভাইবোন ইত্যাদির নিবিড় গন্ধ পাওয়া যায়, যে বাংলাদেশের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বজুড়ে আকাশে বাতাসে সেই গানের মধ্যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ফুটে ওঠে না!? এই গান বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করছে? সত্য তায়েব উর রহমান! কি অদ্ভুত এক যুক্তি! কি বিচিত্র এই বাঙালি!!
৭) রবীন্দ্রনাথ ভারতভাগের বিরোধীতা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় তিনি বাংলাভাগের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন। কেন করেছিলেন? কারণ তিনি বাঙালীদের মধ্যে ভাঙ্গন হ'ক চাননি। তিনি চেয়েছিলেন বাঙালীর ঐক্য, বাঙ্গালীর সম্প্রীতি অটুট থাকুক, বাঙালী মিলেমিশে থাকুক, সেখানে তিনি হিন্দু মুসলমান দেখেননি, তিনি দেখেছিলেন বাঙালি, বাঙালি, বাঙালি। তাই তিনি বাংলা ভাগকে আটকাতে পথে নেমেছিলেন। সেটা অন্যায় করেছিলেন? তখন তো আপনারা, আপনাদের পূর্বপুরুষ পাকিস্তানের অংশ হ'তে চেয়েছিলেন, তখন বাংলাদেশ কোথায় ছিল? জোর ক'রে অযৌক্তিকভাবে ভুলকে ঠিক, মিথ্যেকে সত্যি প্রমাণ করতে সব গুলিয়ে ফেলছেন? ১৯০৫ সালে বাংলাদেশ কোথায় ছিল? তখন তো আপনি, আপনারা জন্মাননি। তখন ভাঙনের বিষ তো এত তীব্র ছিল না। তাই হিন্দু মুসলমান বাঙালি মানুষ নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে। আর, আজ সেই ভাঙ্গনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মানুষটাকে শয়তান রূপে বাংলাদেশ বিরোধী ব'লে তুলে ধরছেন? ঐক্যের পক্ষে, মিলনের পক্ষে, গড়ার লক্ষ্যে, সর্বনাশা ভাঙনের হাত থেকে ঐক্যবদ্ধ বাংলাকে অটুট রাখাটা রবীন্দ্রনাথের অপরাধ ছিল? এর পরেও ভাঙ্গনের মন্ত্রে দীক্ষিত হ'য়ে আবার অখন্ড বাংলার স্বপ্ন দেখেন?
৮) বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা মানেই বাংলাদেশের বিরোধীতা তাও আজ থেকে ১১৯ বছর আগে? বাংলাদেশ তো দূরের কথা পাকিস্তান রাষ্ট্রের কোনও সম্ভবনা ছিল না তখন। এর থেকে প্রমাণ হয়, তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ ও আসামের লেফটেনান্ট গভর্নর ব্যাম্পফিল্ড ফুলার বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে নির্যাতন শুরু করেন এবং সাম্প্রদায়িকতার যে ভয়ংকর বিষ বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেন সেটা সঠিক ছিল। বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা শুনে পূর্ব বঙ্গের মুসলিমরা, বিশেষ করে অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় হতাশ হয়ে পড়ে ও প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
যা আজও আপনারা ব'য়ে চলেছেন। আর, এই জাতীয় সঙ্গীত বিরোধীতাকে আপনারা স্বাভাবিক ঘটনা বলছেন। বাঃ! চমৎকার মানসিকতা। তাহ'লে সরাসরি হিন্দু বিরোধীতার তাস খেললেই হয়। সরাসরি হিন্দু-মুসলমান আলাদা হওয়ার দাবী তুললেই সব সমস্যার সমাধান হওয়ার একটা রাস্তা খুলে যায়। তাই-ই হ'ক আর রবীন্দ্রনাথ হ'ক বাতিল।
৯) আপনি জাতীয় সঙ্গীতের ভূমিকা নিয়ে কথা তুলেছেন। সঙ্গে বলেছেন, এই গানে স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনও কথা নেই। এই গান সংকট বা দূর্দিনে আপনাদের জাগিয়ে রাখতে অক্ষম। আরো বলেছেন, এই গানের পরিবর্তে "এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি" কিংবা "মুক্তির মন্দির সোপান তলে" গানগুলো আপনাদের দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করে।
আপনাকে আমার জিজ্ঞাস্যঃ
**এবার বলি,
**"মুক্তির মন্দির সোপান তলে" গানের কথাগুলি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ের সময়ের গান। 'আমার সোনার বাংলা' অখন্ড ভারতের অখন্ড বাংলায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধ সময়ের গান ছিল ব'লে জাতীয় সঙ্গীত হ'তে পারবে না তাহ'লে কোন যুক্তিতে অখন্ড ভারতের সময়ের গান "মুক্তির মন্দির সোপান তলে" আপনাদের জাতীয় সঙ্গীত ব'লে গ্রহণযোগ্য হবে?
*** যে গানগুলো আপনাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু ক'রে দাঁড়াতে সাহায্য করে সেই দেশটা সম্পর্কে আপনার জানা আছে? সেই দেশটা সম্পর্কে তীব্র ভালোবাসা জন্মালে পরে তবেই কোনও গান দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু ক'রে দাঁড়াতে সাহায্য করে নতুবা করে না। আপনার দেশের ভৌগলিক অবস্থান, আয়তন, গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ, আবহাওয়া, আকাশ, বাতাস, মাঠ, ঘাট, পুকুর, নদনদী, লোকসংখ্যা, বাংলাদেশের মাটি, জল, বায়ু, ফল, বাংলাদেশের ঘর, হাট, বন, মাঠ এবং বাঙ্গালীর পণ, আশা, কাজ, ভাষা, বাঙ্গালীর প্রাণ, মন, ভাইবোন ইত্যাদি সমস্ত কিছুর সঙ্গে আত্মিক একটা যোগসূত্র রচিত হয়, তীব্র ভালোবাসা জন্মায় এমন গান আগে শুনুন তারপর না হয় দেশপ্রেম জাগাবেন, তারপর নাহয় মাথা উঁচু ক'রে দাঁড়াবেন।
১০) প্রতিদিন প্রতিনিয়তই আপনাদের একেকজন এক একরকমভাবে ধর্মীয় বাণীর ব্যাখ্যা করছে সেটা আপনি ভালোভাবেই জানেন, তাই আজ সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্ম নিয়ে হানাহানি।
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করতেই পারেন কিন্তু তার জন্য এত বাহানা, এত অজুহাত, এত সমালোচনা, এত নিন্দা, এত অপবাদ, অপমান, অশ্রদ্ধা, কুৎসা, গালাগালি, তাঁর মূর্তি ভাঙ্গা, তাঁকে চোর আখ্যা দেওয়া, অত্যাচারী জমিদার বলা, তাঁর ছবির চারপাশে আরও নানারকম মিথ্যা, ঘৃণ্য অপবাদের মালা সাজিয়ে তাঁর ছবি পোষ্ট করা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করার কি কোনও প্রয়োজন ছিল। এতে কাদের মাথা নীচু হ'লো বিশ্বে ইতিহাসের বুকে যা সাক্ষী হ'য়ে থাকবে?
আমার কথা জানালাম। গ্রহণ করতে পারেন ও বর্জনও করতে পারেন। ( লেখা ১১ই সেপ্টেম্বর' ২০২৪ )

No comments:
Post a Comment