যাই হোক, এখন মনে যে প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় হ’য়ে দেখা দিয়েছে তা’ হ’ল এই ‘বাঙালি’ জাতটার প্রথম পরিচয় কি? অখন্ড ভারতের অখন্ড বাংলার বাঙালিদের তখন প্রথম পরিচয়টা কি ছিল? শুধুই ‘বাঙালি’ না-কি মুসলমান বাঙালি, হিন্দু বাঙালি, খ্রিস্টান বাঙালি ইত্যাদি? অখন্ড ভারতের অখন্ড বাংলার পশ্চিম অংশকে এবং পশ্চিম অংশে বসবাসকারী তামাম মানুষদের ভারত ভাগের পরে কি বলা হ’ত? পশ্চিমবঙ্গ এবং বাঙালি। কিন্তু পূর্বদিকের অংশকে এবং অধিবাসীদের কি বলা হ’ত? পূর্ববঙ্গ না-কি পূর্ব পাকিস্তান? বাঙালি না-কি অন্য কিছু? ভারত ভাগের পর থেকে বলা হ’ত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এবং বাঙালি বলার থেকেও বেশী ক’রে যেটা বলা বা বোঝানোর চেষ্টা হ’ত সেটা হ’ল মুসলমান; যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে মুসলমান প্রধান অঞ্চল হিসাবে দেশটাকে ভাগ করা হয়েছিল ব্রিটিশের মদতে অখন্ড ভারতের ক্ষমতালোভী স্বার্থান্বেষীদের সহযোগিতায়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ আমরা যাকে পূর্ব বাংলা বলতাম তার প্রধান ভাষা, মাতৃভাষা ‘বাংলা’ বাদ দিয়ে উর্দু ভাষাকে প্রধান ভাষা করতে চেষ্টা করেছিল এবং মুছে দিতে চেয়েছিল বাঙালির ‘বাঙালি’ সত্তা। কিন্তু সেদিন বাঙালির বাঙালি সত্ত্বা জেগে উঠেছিল, খুলে গেছিল ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির অগ্নিমুখ। সেদিন কিন্তু হিন্দু বাঙালি, মুসলিম বাঙালি, খ্রিষ্টান বাঙালি ব’লে কিছু ছিল না। সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম শাসকরা হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান ইত্যাদির বাংলা তথা ‘বাঙালি’ সত্ত্বাকে চেয়েছিল মুছে দিতে, মুসলিম বাঙালি ব’লে কাউকে ছাড় দেয়নি। সেদিনের নির্ম্মম বেদনায়ক ইতিহাস সবার জানা আছে। আর তার আরও অনেক পরে ‘বাংলাদেশ’-এর জাতির পিতা মুসলিম বাঙালি মুজিবর রহমানকেও হত্যা করতে সেদিন হাত কাঁপেনি পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম শাসকের এমনকি বাংলাদেশের মুসলিম বাঙালির। মুসলমান ব’লে তাঁকে দুর্বৃত্তরা সেদিন রেহাই দেয়নি। মুসলিম বাঙালির হাতেই তাঁকে প্রাণ দিতে হ’ল; সেই কথা আমরা যেন ভুলে না যায়। একথাও আমরা ‘বাঙালি’রা যেন না ভুলে যায় যে দুর্বৃত্তদের কোনও জাত বা ধর্ম্ম নেই তা সে হিন্দু বাঙালি দুর্বৃত্ত হ’ক, মুসলমান বাঙালি দুর্বৃত্ত হ’ক, খ্রিষ্টান বাঙালি দুর্বৃত্ত হ’ক আর যাই হ’ক না কেন, দুর্বৃত্ত দুর্বৃত্তই। তার কোনও জাত নেই, নেই কোনও ধর্ম্ম, নেই কোনও সম্প্রদায়। কিন্তু সমাজ সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত বাংলাদেশের ‘বাঙালি’ এলিট সমাজের মানুষেরা কি বলেন? এই যে বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় (শুধু ব্রাহ্মণবেড়িয়া নয় এমন বহু) অমানবিক ঘটনার সাক্ষী হ’য়ে রইলো গোটা বাংলাদেশ তথা ‘বাঙালি’ জাতি সেই দেশ তথা বাঙালি জাতির কাছে একজন বাঙালি হ’য়ে আমার জিজ্ঞাস্য এই লজ্জা কার? এই ঘটনা কারা ঘটালো? এই ঘটনার দায় কার? ফেসবুকের মাধ্যমে কে বা কারা ইসলামের অবমাননা বা অপমান করলো? সে কি হিন্দু? সে কি ছদ্মবেশী অন্য কেউ? না-কি সে বাঙালি? ইসলাম অবমাননার প্রতিবাদে প্রতিশোধের মানসিকতায় যে নির্ম্মম নৃশংস ঘটনা ঘটলো ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় সেই ঘটনা কারা ঘটালো? তারা কি মুসলিম? তারা কি বাঙালি? এই ঘটনা কি অজ্ঞানতার ঘোর অন্ধকার আর ভিত্তিহীন আবেগসর্বস্ব বিকৃত মানসিকতার তাৎক্ষণিক ফসল না-কি শুরু থেকে শেষ সবটাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পূর্ব পরিকল্পিত? এই জঘন্য খেলায় হিন্দু মুসলিম উভয় পক্ষই আমার মতে ‘বাঙালি’ পুতুল নয়তো? তাহ’লে পুতুল খেলার কারিগর কে বা কারা? কার বা কাদের হাতে পুতুল নাচানোর দড়ি বাঁধা আছে আর কারাই বা তাদের হাতে নাচছে? কেন নাচছে?
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment