হিন্দু নেতার বিরুদ্ধে হিন্দু কবির প্রতিবাদ আর হিন্দু কবির পিছনে আর এক হিন্দু ছাত্রের জেহাদ।
কবি শ্রীজাত শুনলাম আপনাকে পুলিশ নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। কেন? খোঁজখবর নিয়ে যা জানলাম তা হ’ল কবি আপনি নাকি একটা কবিতা লিখেছেন। কবিতার নাম ‘অভিশাপ’। কবিতাটি আপনি নাকি গত ১৯শে মার্চ শনিবার সন্ধ্যায় ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। সেই কবিতার বিষয়বস্তুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অর্ণব সরকার নামে একজন কলেজ ছাত্র শিলিগুড়ির সাইবার ক্রাইম পুলিশ ষ্টেশনে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। খবর পড়ে জানতে পারলাম অর্ণব সরকারের বক্তব্য, ‘এই ধরনের পোস্ট ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত ধর্মাচরণের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার এক গভীর চক্রান্ত।‘
যাই হ’ক এখন প্রশ্ন কবিতার বিষয়বস্তু কি ছিল যা নিয়ে এতবড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হ’ল কবি আপনাকে? এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাবার আগে দেখে নেওয়া যাক কবি আপনার কবিতাটিকে।
কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সেই কবিতাটিঃ
অভিশাপ
সময়ে ওষুধ, নইলে বেড়ে যায় সব রকম রোগই
ভিখ পেতে পেতে তুমি রাজা হ'য়ে ওঠো, গেঁয়ো যোগী।
উঠেই নির্দেশ দাও, ধর্মের তলব দিকে দিকে
মৃগয়ায় খুঁজে ফেরো অন্য ধর্মের নারীকে।
যে-হরিণ মৃত, তারও মাংসে চাও অধিকার
এমন রাজত্বে মৃত্যু সহজে তো হবে না তোমার।
বাতাসে হাপর নামে, দেশ জুড়ে অধর্মের ছাই.........
প্রতি নির্বাচনে আমরা শতাব্দী পিছনে ফিরে যাই।
যেখানে পুরুষধর্ম ধর্ম-পুরুষের অন্য নাম
আর আমি নারীর মৃত্যু পার করেও শিকার হলাম।
আমাকে যদ্দিন ধর্ষণ করবে কবর থেকে তুলে-
কন্ডোম পরানো থাকবে, তোমার ধর্মের ঐ ত্রিশূলে!
এই কবিতার বিষয়বস্তু কি? বলা হচ্ছে, কবিতাটি উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটের ফল এবং তারপর যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া প্রসঙ্গে লেখা। এই কবিতার শেষ দুটি লাইন নিয়েই নাকি অর্ণব সরকারের মূল আপত্তি। তাই তিনি কবিকে গ্রেপ্তারের দাবী জানিয়েছেন।
এখন স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে কবিতার এই “আমাকে ধর্ষণ করবে যদ্দিন কবর থেকে তুলে--- কন্ডোম পরানো থাকবে, তোমার ঐ ধর্মের ত্রিশূলে”! শেষ দুই লাইনের অন্তর্নিহিত মানে কি? কবিরা কবিতা লেখেন অনেক জটিলতার আবরণে। সেখানে অনেক শব্দের জাগলারি হয়, অন্তর্নিহিত অনেক ব্যাপার স্যাপার থাকে যা কবির মনের বাগানে ফুল হ’য়ে ফোটে, খেলা করে। সেসব অর্থ আমার বোঝা হ’য়ে ওঠে না যদি না কেউ বুঝিয়ে দেয়। তাই কবিতা পড়া আমার হ’য়ে ওঠে না। সোজা সাপটা হ’লে অবশ্য পড়ি। যাই হ’ক, কবি শ্রীজাত আপনার এই পুলিশি ব্যাপারটা আমাকে কৌতূহল ক’রে তুললো আর তাই একটু ঘাঁটাঘাঁটি ক’রে দেখতে চাইলাম আসলে গলদটা কোথায়?
একটু ঘাঁটাঘাঁটি ক’রে যা জানলাম------তা সত্যি কি মিথ্যা জানি না-------তা হ’ল যোগী আদিত্যনাথ নাকি এক জনসভায় বলেছিলেন , এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মৃত নারীদের কবর থেকে তুলে এনে নাকি ধর্ষণ করা যায়! এই কথাটা সত্যি মিথ্যা প্রমাণ করার দায় আমার নয় এটা প্রমাণ করার দায় প্রশাসনিক স্তরে বর্তায়। কিন্তু এই কথার সঙ্গে কবির কবিতার শেষ দুটি লাইনের প্রথম লাইনটার মিল আছে। এখানে কবিতার এই লাইনের অন্তর্নিহিত অর্থ পরিস্কার। কিন্তু কবির কাছে আমার জিজ্ঞাস্য আপনি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘আপনি আপনার নিজের বিশ্বাস ও প্রতিবাদের অবস্থান থেকেই এই পোস্টটি করেছেন এবং এর জন্য আপনার বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই।‘ আপনি আরও জানিয়েছেন, ‘ঘটনাটি (অর্ণব সরকারের কবির বিরুদ্ধে F.I.R বিষয়টি) দুর্ভাগ্যজনক ও হাস্যকর। ধর্ম এত ঠুনকো বা সহজ নয় যে তাকে এত সহজে আঘাত করা যায়। কোনো ঘটনার বিরোধিতা করা জরুরী মনে করলে আপনি তা সপাটেই করেন। আপনার প্রতিবাদের ভাষা কবিতা আর আপনি তাই করেছেন।‘ এর সঙ্গে আপনি দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আপনার আস্থার কথা জানিয়েছেন। আর গণতান্ত্রিকভাবে সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে ব’লে মনে করেন।
আচ্ছা কবি শ্রীজাত আপনি সংবাদ মাধ্যমকে এত কথা বলতে পারলেন আর আপনি আপনার কবিতা রচনার পটভুমিটা কেন বলেন নি বা বলেন না? দেশের মানুষের যখন এই নিয়ে কৌতূহল চরমে ওঠে তখন কেন আপনি আপনার কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ আম আদমির সুবিধার্থে খুলে বলেন না। আপনারা বুদ্ধিজীবী মানুষ আর আম আদমি চাষাভুষা চার অক্ষর; তাদের অন্ধকারে রাখেন কেন? কেন বলেন না আপনার কবিতার জন্মের গর্ভ যন্ত্রণার কথা? আপনি না বললে সাধারণ মানুষ বুঝবে কি করে আপনি কতবড় মাপের প্রতিবাদের ময়দানে প্রথম পা রেখেছেন? আপনি একা একা মনের কথা মনে পুষে রেখে লড়াই করতে চান? একা বোকা নয় কি? আপনি সংবাদ মাধ্যমকে বলবেন এটা ভালো কথা কিন্তু যে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে আপনি আপনার কলমকে অস্ত্র হিসাবে বাগিয়ে ধরেছেন, কবিতা লিখেছেন সেই কবিতার মানে আপনারা মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীরা ছাড়া বোঝে ক’জন? আর কবিতার প্রেক্ষাপট জানা না থাকলে তাই বা বোঝে ক'জন? পড়েই বা ক'জন? আর যখন আপনাদের দুর্বোধ্য কবিতার কোনোকারণে প্রচার ঘটে, আম জনতার আলোচনার বিষয় হ'য়ে ওঠে তখন কেন সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কবিতার দুর্ভেদ্য খোলসকে খুলে ফেলে দিয়ে অন্তর্নিহিত অর্থকে সহজ সরল ক'রে দিয়ে কবিতাকে রাহু, কেতু মুক্ত করেন না? অর্ণব সরকার কবিতার যে শেষ দুটো লাইন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন সেই শেষ দুটো লাইনের মানে ১৩৩ কোটি নাগরিকের ক’জন বুঝেছে? ক’জন বোঝে অর্ণব সরকারের করা শ্রীজাতর কবিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত ধর্মাচরণের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার এক গভীর চক্রান্ত’ টা কি? কিন্ত আপনার কবিতা কিম্বা অর্ণব সরকারের অভিযোগের ভিত্তি কেউ বুঝুক আর না বুঝুক ক্ষতি যা হবার তা’তো উভয়ত হ’য়ে যেতে পারে না-কি কবি শ্রীজাত? বিষয়টা নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা বৃহত্তর স্বার্থে হতেই পারে না-কি? সামাজিক বৃহত্তর স্বার্থে এই দায়বদ্ধতা আপনি অস্বীকার করতে পারেন কি কবি শ্রীজাত? প্রতিবাদ যখন করবেন তখন গভীর দূরদৃষ্টির প্রয়োজন বলেই মনে হয় আমার। আপনার পাশে কে থাকলো আর না থাকলো সেটা বড় কথা নয়-------যদিও এখনও পর্যন্ত আপনার পাশে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাউকে দাঁড়াতে দেখা যায়নি; দাঁড়াবে যখন কেউ বা কোনও রাজনৈতিক নেতা দাঁড়াবার নিরাপদ জমি তৈরী করে দেবে------বড় কথা হ’ল আপনার কবিতা লেখার পারস্পেকটিভ টা কি সেটা তুলে ধরা। কোন পরিপ্রেক্ষিতে আপনি বিদ্রোহী হ’য়ে উঠলেন সেটা জানার অধিকার আছে বৈকি আমজনতার। কিন্তু আপনি সেটা আমল দেননি। আশা করি মানুষের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে, সভ্যতার স্বার্থে, হিন্দু ধর্মের স্বার্থে আপনি আপনার কবিতার তাত্ত্বিক খোলসকে খুলে ফেলে খোলামেলা নাংলা ভাষায় বলুন আপনার মনের কথা দেশের ন্যাংলা মানুষের কাছে। আমি অপেক্ষায় রইলাম।
এবার আসি কবিতার বিষয়ে। আপনি যথার্থই বলেছেন ধর্ম সত্যিই ঠুনকো নয়। পারমাণবিক শক্তি বা আরও অন্য কোনো কিছু আছে কিনা জানা নেই যা দিয়ে ধর্মের নামে অধর্মকে, ধর্মের বিকৃত রুপকে, ধর্ম নিয়ে ব্যবসাকে ও ব্যবসাকারীকে আঘাত করতে পারে কিন্তু 'ধর্ম'-কে কদাপি নয়। ক্ষমতা নেই তাকে ধ্বংস করে। তাকে আঘাত করা, ধ্বংস করা মানে সৃষ্টিকে আঘাত করা, ধ্বংস করা। আর কন্ডোমটা কিসের হবে যেটা ত্রিশূলের ডগায় পরাবেন? লোহার বা পিতলের ত্রিশূলে সিন্থেটিক উপাদানে তৈরী কন্ডোম কি কোনও কাজে আসবে? এটা তো চরম অসুরক্ষিত, তাই নয় কি কবি শ্রীজাত? ত্রিশূলের কন্ডোমের উপাদান কি হবে সেটা ভাবতে হবে বৈকি কবি। আর কন্ডোম পরালেই বা কি আর না পরালেই বা কি? তা’তে কি ধর্ষণের সংজ্ঞা বদলে যাবে? না-কি সেটাকে ধর্ষণ বলা হবে না? কন্ডোম পরালেই কৌমার্য অক্ষুণ্ণ থেকে যাবে, সতীত্ব নষ্ট হবে না, ইজ্জৎ রক্ষা পাবে? এছাড়া মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন আপনি। স্বাধীনতা বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন সেটাও খোলসা হওয়া দরকার। স্বাধীনতা মানে কি উচ্ছৃঙ্খলতার প্রশ্রয় পাওয়া? যার যা ইচ্ছা সমাজ, সভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলা ও করা?
আর অর্ণব সরকার ও অন্যান্য যারা শ্রীজাতর কবিতার শেষ দু’টি লাইন নিয়ে আপত্তি করেছেন তাদের কাছে জিজ্ঞাস্য আপনি বা আপনারা কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট কি তা ভেবে দেখেছেন? এ তো ল্যাজা মুড়ো বাদ দিয়ে পেটি নিয়ে লম্ফঝম্প! কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট যদি রাজনৈতিক সমাবেশে যোগী আদিত্যনাথের এই ভাষণ ‘এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মৃত নারীদের কবর থেকে তুলে এনে ধর্ষণ করা যায়’ হয়ে থাকে তাহ’লে সেই ভাষণ কি ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত ধর্মাচরণের অধিকারকে রক্ষা করে, সম্মান করে? কি বলেন অর্ণব সরকার ও অন্যান্যরা? কবিতা লেখার অপরাধে যদি কবিকে গ্রেপ্তার করা হয় তাহ’লে রাজনৈতিক সমাবেশে বলা বক্তব্যের জন্য যোগীকে কি করা হবে অর্ণববাবু? দেশের আইন কি বলে? যোগীর বক্তব্য যদি সত্য হয় যা তিনি রাজনৈতিক সমাবেশে বলেছিলেন, যে বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কবি শ্রীজাত কবিতা রচনা করেছিলেন সেই বক্তব্যের জন্য অর্ণব সরকার কিছু বলবেন? এ ক্ষেত্রে আপনার শিক্ষা, রুচি, সভ্যতা, মানসিকতা ও মানবিকতা, নীতিবোধ কি বলে? এ ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধান কি অপমানিত, লাঞ্ছিত, আঘাত প্রাপ্ত ও ধর্ষিত হচ্ছে না? কবি শ্রীজাত হিন্দু হ’য়ে যদি হিন্দু নেতাকে, হিন্দু নেতার ধর্মবিশ্বাসে আঘাত ক’রে থাকে তাহ’লে আদিত্যনাথ একজন হিন্দু যোগী হ’য়ে যদি রাজনৈতিক সমাবেশে এই কথা ব’লে থাকেন তাহ’লে কি বিশ্বের তামাম মাতৃজাতিকে, মাতৃজাতির মাতৃত্বের প্রতি বলাৎকার করেননি? হিন্দু ধর্মকে অপমান করেননি? তামাম যোগীকূলের ভাবমূর্তিকে আঘাত করেননি? আপনি কি মনে করেন সমগ্র হিন্দু সমাজের আপনারা অভিভাবক? সমগ্র হিন্দু সমাজ যেহেতু যোগীজি হিন্দু তাই যোগীজির এই নারীঅবমাননাকারী উক্তিকে, লজ্জাস্কর অপমানজনক বক্তব্যকে জেনে বুঝে স্বীকৃতি দেবেন? সম্মানের উচ্চাসনে বসাবেন? কথায় আছে ‘আপনি আচরি ধর্ম, পরেরে শেখায়’। এই কথা আপনি জানেন তো অর্ণব সরকার? আপনি তো একজন কলেজ ছাত্র; আপনার বিবেক কি বলে? এক ফোঁটা চোনা যেমন গোটা কড়াই-এর দুধকে কেটে দেয় ঠিক তেমনি একজনের আলটপকা কান্ডজ্ঞানহীন নির্লজ্জ অপমানজনক মন্তব্যের জন্য গোটা দলটাকে তার চরম খেসারত কি দিতে হয় না? দলের সবাই কিসের জন্য এই ধরণের সর্বনাশা মন্তব্যের পরেও পাশে দাঁড়ায়? আখেরে কি কিছু লাভ হয়? না-কি এই একজন দুজনের জন্য গোটা দলটাই খাদের কিনারায় এসে দাঁড়ায়? একটু কান পেতে শুনুন ‘ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে’!!!!!!!!!!!!!!!!
সাধু সাবধান ! কি সুন্দর মেলবন্ধন!!! একজন হিন্দু কবি একজন হিন্দু নেতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরোব হয়েছেন ঠিক তেমনি একজন হিন্দু কলেজ ছাত্র একজন হিন্দু কবির পিছনে লেগেছেন। এদিক থেকে হিন্দুদের ঐক্য দেখার মত! আর এই পিছনে লাগার মধ্যে দিয়ে অখ্যাত অর্ণব প্রচারের আলোয় চলে এলেন। এই ধরণের সস্তা প্রচারের লোভ অনেক বড় সর্বনাশা বিপদ ডেকে আনতে পারে। আশা করি দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল, দলের নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় ও সমস্ত সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ, সমস্ত বুদ্ধিজীবী সুধীসমাজ এই বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।
যাই হ’ক, আমার বোধবুদ্ধি অনুযায়ী যা মনে এলো তাই তুলে ধরলাম। দুজনের কাছেই উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। নমস্কার।
Written on 25th March'17
https://www.kobikolpolota.in
ReplyDelete